30 C
Dhaka
Friday, October 17, 2025

পারিবারিক নৃশংসতা শিশু হামিম আর কখনও বাবা ডাকতে পারবে না

এক বছরের শিশু হামিম জানে না, আর কখনও বাবা ডাকতে পারবে না সে। অপরদিকে তার বোন হুমাইরার মুখে বাবা ডাক থামছে না কিছুতেই। ছোট্ট দুই শিশুকে নিয়ে স্বামী হত্যার বিচারের দাবিতে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন রিতু আক্তার।

ময়মনসিংহে ঘটছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। জেলায় গত ৫ মাসে হত্যা মামলা হয়েছে ৪৮টি। পারিবারিক কলহে বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়াই এর মূল কারণ। সেই সঙ্গে রয়েছে বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতাও। এছাড়া অপরাধকেন্দ্রিক নানান টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন কৌশল রপ্ত করছে অপরাধীরা।

জেলা সদরের পাড়াইল এলাকায় জমি নিয়ে বিরোধে গত ৪ জুন মধ্যরাতে খুন হন রিতু আক্তারের স্বামী রমজান আলী। মাছ ব্যবসায়ী রমজান আলীকে পিটিয়ে হত্যা করে তারই আপন চাচা ও চাচাতো ভাইয়েরা। এ সময় হাত ভেঙে দেয়া হয় রমজানের বাবা লাল মিয়ারও। নিজের ভাই-ভাতিজাদের হাতে ছেলের এমন মৃত্যু তিনি মেনে নিতে পারছেন না কিছুতেই।

আরও পড়ুনঃ  সাকিবের নিরাপত্তা ইস্যুতে এবার যা বললেন উপদেষ্টা রিজওয়ানা

লাল মিয়া বলেন, ‘আমি কখনই ভাবিনি আমার ভাই-ভাতিজার হাতে আমার ছেলের প্রাণ যাবে। আমাকেও তারা আহত করবে। তারা সবই করল শুধুমাত্র জমিজমার জন্য।’

নিহতের স্ত্রী রিতু আক্তার বলেন, ‘আমার মেয়েটা সারাক্ষণ বাবা বলে কান্নাকাটি করছে। দুইটা বাচ্চাকে নিয়ে কীভাবে আমি একা চলব। এখন তো আমার সবই শেষ। আমার বাচ্চারা যেন অন্তত দেখতে পারে তাদের বাবার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে, এটাই আমার চাওয়া।’

জেলার বিভিন্ন স্থানে এভাবে ঘটছে একের পর এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড, উদ্ধার হচ্ছে লাশ। চাচাতো বোনকে গোপনে বিয়ে করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সৌরভকে হত্যা করে তারই চাচা ইলিয়াস। হত্যার পর মরদেহকে করা হয় ৪ খণ্ড। গত ২ জুন ময়মনসিংহ-মুক্তাগাছা সড়কের মনতলা ব্রিজের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয় সৌরভের খণ্ডিত লাশ। এছাড়া ২১ মে ত্রিশালে স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তানকে হত্যা করে মাটিতে পুঁতে রাখে স্বামী আলী হোসেন। এসব ঘটনা নাড়া দিয়েছে পুরো দেশের মানুষকে।

গত ৫ মাসে জেলায় হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৪৮টি। সবচেয়ে বেশি ১০ মামলা কোতোয়ালি মডেল থানায়। এসব হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনসহ গ্রেফতার হয়েছে ১০১ জন আসামি।

আরও পড়ুনঃ  বিএনপির সমাবেশে ককটেল ও গুলি ছোড়ার অভিযোগ, আহত ৭

জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, জানুয়ারি মাসে হত্যা মামলা হয়েছে ৫টি ও গ্রেফতার ৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৬ মামলায় গ্রেফতার ১৯, মার্চ মাসে ৮ মামলায় গ্রেফতার ২৯, এপ্রিলে মামলা ১৯ ও গ্রেফতার ৩০ এবং মে মাসে মামলা হয়েছে ১০টি ও গ্রেফতার হয়েছে ১০ জন।

পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, পারিবারিক কলহেই ঘটছে বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ড। একটি ঘটনার নৃশংসতা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আরেকটিকে। আর এতে উৎকণ্ঠায় সাধারণ মানুষ।

স্থানীয়রা বলছেন, ময়মনসিংহে আগে এমনটা কখনোই দেখেননি তারা। হঠাৎ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়ে গেছে। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক বন্ধনে চিড় ধরা, অস্থিরতা ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব-টানাপোড়েনে বাড়ছে আপনজন হত্যার প্রবণতা। সেইসঙ্গে বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতাকে দায়ী করেছেন অনেকে। এছাড়া অপরাধকেন্দ্রিক নানা অনুষ্ঠান ও সিরিয়ালে দেখানো গল্পের মধ্য দিয়ে অপরাধীরা শিখছে নানা কৌশল ও অপরাধ লুকানোর উপায়।

ময়মনসিংহের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম ইতি বলেন, ‘পারিবারিক বন্ডিংটা কমে গেছে। এতে সবাই এককেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। মানুষের মধ্যে আক্রোশ, লোভ-লালসা এতটাই তৈরি হয়েছে যে তাৎক্ষণিকভাবে নিজেদের সামলাতে পারছে না। তাই তুচ্ছ বিষয় নিয়েও হত্যার মতো ঘটনা ঘটাতে একবারও ভাবছে না।’

আরও পড়ুনঃ  ভারত থেকে যেসব পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিল বাংলাদেশ

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মাহবুব আলম মামুন বলেন, ‘এ মামলাগুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত বিচার করতে হবে। সাক্ষীদের যেন সাক্ষ্য দিতে এসে একবারও ফেরত না যেতে হয়। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে দ্রুততম সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই অপরাধ করার আগে অবশ্যই ভাববে।’

পুলিশ বলছে, দ্রুততম সময়ে হত্যার রহস্য উদঘাটনের পর আইনের আওতায় আনা হচ্ছে আসামিদের। পাশাপাশি পারিবারিক হত্যাকাণ্ড রোধে বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে কাজ করছেন তারা।

পুলিশ সুপার মাছুম আহাম্মদ ভূঞা বলেন, ‘সামাজিক অপরাধ প্রবণতা রুখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক প্রতিরোধও দরকার। বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে সেটাই তৈরি করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

আপনার মতামত লিখুন:
সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ