30.4 C
Dhaka
Wednesday, June 25, 2025

কিছু নির্মম ইতিহাস টাইমলাইনে থাকুক: তাসরিফ খান

দেশের অন্যতম সঙ্গীতশিল্পী তাসরিফ খান। কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে শুরু থেকেই সরব ছিলেন ‘কুড়েঘর’ ব্যান্ডের এই সদস্য। এই আন্দোলনের মোড় ঘুরাতে তাকে নিয়ে জোরপূর্বক একটি ভিডিও বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছিল পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকার। এ নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন তাসরিফ।
তাসরিফ খানের স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

২৩ জুলাই রাত রাত ১ টার কথা বলছি। একজন সিনিয়র ইনফ্লুয়েন্সার কল দিয়ে বললো, “তাসরিফ, তোর বাসার নিচে নাম, চা খাইতে আসতেছি, গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে”।
৫ জুলাই থেকে ছাত্রদের পক্ষে বিভিন্ন পোস্ট করা, কবিতা লিখতে থাকা এবং ‘রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম’ গান টা ফেসবুকে চলতে থাকায় সরকারি গুন্ডা বাহিনীর থ্রেটে আমি তখন বাসার বাইরে অবস্থান করছিলাম।

ওই সিনিয়র ইনফ্লুয়েন্সারের কথায় বিশ্বাস করে, আমি তখন বাসার সামনে আসি উনার সাথে দেখা করতে। গাড়ি থেকে ৬-৭ জনের মত নেমে আসে। ইনফ্লুয়েন্সার সাহেব আমাকে একটু সাইডে নিয়ে আস্তে করে বুঝিয়ে বলে, “সাথে যারা আছে তারা একটা এজেন্সির লোক এবং আইন প্রয়োগ সংস্থার বাহিনীর কয়েকজনও আছে এখানে”।

আমি তখন উনার কাছে জানতে চাই যে উনারা কেন এসেছেন কি চাচ্ছেন মূলত! উনি তখন বুঝায় বলে, “সরকারি একটা কাজ আছে, এই সরকার আরও ৭-৮ বছর ক্ষমতায় থাকবো। আমরা ঠিকমত বাঁচতে চাইলে সরকারের পক্ষে কাজ করতে হইবো, এর বাইরে কোন রাস্তা নাই।” এই কথা বলে উনি আবার আমাকে গাড়ির কাছে নিয়ে যায়। সেই ৬-৭ জনের মধ্য থেকে একজন আমাকে বলে, “তাসরিফ, তোমাকে আমরা চিনি। আমরা তোমাকে একটা স্ক্রিপ্ট দিতেছি, ছোট্ট একটা ভিডিও করতে হবে। এই ভিডিওটা আমাদের কালকের মধ্যে লাগবে। পরশু সরাসরি প্রধানমন্ত্রী এই ভিডিওটা দেখবে এবং তারপর তুমি আপলোড করবা”।

আরও পড়ুনঃ  শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ডানার তাণ্ডব চলবে রাত থেকে ভোর পর্যন্ত

সেই ইন্সুরেন্সার তাদের সাথে সুর মিলিয়ে আমাকে বলে, “দেখ তাসরিফ, পিএম এর চোখে পড়ার এটাই সুবর্ণ সুযোগ, ভিডিওটা ভালো করে কর, সরকার যতদিন আছে সুবিধা পাবি”। কথা শেষ করার আগেই উনি পকেট থেকে এক লক্ষ টাকার তিনটা বান্ডেল, মোট তিন লক্ষ টাকা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “এইটা সামান্য ছোট একটা গিফট! টাকা যত চাস, তত দেয়া হবে, ভিডিওটা সুন্দর কইরা কর”।

ঠিক এই সময় আমার ফোনে আমার ব্যান্ডের ড্রামার শান্তর নাম্বার থেকে একটা কল আসে। ফোন রিসিভ করতেই শান্ত আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “তাসরিফ! পাঁচ ছয় জন পুলিশ এবং সিভিল ড্রেসের কয়েকজন মিলায়ে আমাকে রোল দিয়া সারা শরীরে মারছে!” শান্তর কথা শুনে আমার হাত-পা একরকম কাঁপতে থাকে। আমি বোঝার চেষ্টা করি, এই মাইর খাওয়াটা কি আমাকে এদিকে রাজি করানোর জন্য ভয় দেখানো? নাকি কেবলমাত্র একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা? শান্তর লাইন কেটে যায়।

আমি আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয় দেওয়া তাদেরকে বলি, “ভাই, এইমাত্র কয়েকজন মিলে আমার ভাই, আমার ব্যান্ডের ড্রামার শান্ত কে প্রচুর মারছে!”। ওরা জাস্ট আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “আরেহ! দেশের যে অবস্থা, এটা এখন কিছু করা যাবে না। ওরে বলো বাসায় চলে যাইতে”।

আমার তখন মাথায় আসে, এখন যদি আমি ওদেরকে টাকা ফেরাই দেই অথবা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানাই, তবে তারা আমাকে চাইলেই গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে ভিডিও করে জোরপূর্বক আপলোড করাতে পারে। আমি তাই মাথা ঠান্ডা করে ওদেরকে বলি ঠিক আছে আমি দেখতেছি কি করতে পারি, কালকের মধ্যে জানাচ্ছি। ওরা আমাকে তখনও একরকম থ্রেট দিয়ে বলে, “ভাই জানাচ্ছির সুযোগ নাই! সিচুয়েশন তো বুঝেনই। ভিডিও কালকেই লাগবে”। সাথে ওই ইনফ্লুয়েন্সারও আমাকে বলে, “তাসরিফ, ভিডিওটা তো পিএম দেখবে সো বুইঝা শুইনা সুন্দর কইরা করিস”।

আরও পড়ুনঃ  আবু সাঈদ হত্যার তথ্য অনুসন্ধান কমিটির সদস্যদের পদত্যাগ

ওদের সাথে কথা শেষ করে আমি বাসায় ফেরত যাই। বাসায় সবাইকে সব সিচুয়েশন জানিয়ে আমি আমার ম্যানেজার আয়মান সাবিত কে ফোন দিয়ে বলি,”আয়মান, আমি বাসা ছেড়ে দিচ্ছি, এই এই ঘটনা ঘটছে। আমি তোকে নাম্বার দিচ্ছি, তুই ওই এজেন্সিকে আমার বাসা থেকে তিন লক্ষ টাকা নিয়ে ওদেরকে দিয়ে দিবি কালকেই। আমি আপাতত বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি, কারণ আমি বাসায় থাকলে ওরা আমাকে তুলে নিয়ে যাবে”।

ওই সময় আমার মনের অবস্থা আমি জানি। আমার বাসার অবস্থা ডায়াবেটিসের রোগী আমার আম্মুর অবস্থা, আব্বুর টেনশন, গুম হয়ে যাওয়ার চিন্তা এবং দেশের সাথে বেইমানি করতে ওরা আমাকে বাধ্য করতে চাচ্ছে, সবকিছুই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সাথে বারবার আমার কানে বাজছে শান্তর ওই কান্না ভরা আর্তনাদ।

কষ্টের ব্যাপার কি জানেন? এই ঘটনার ঘণ্টাখানেক আগে শান্ত আমাকে ফোন দিয়ে বলছিল, “খান, আমার বাসায় আম্মা নাই। এদিকে কারফিউ চলছে, দুপুরবেলা খাওয়া হয় নাই, একটা দোকানও খোলা নাই আমার প্রচন্ড ক্ষুধা লাগছে, কি করব?”। আমি শান্তকে বলছিলাম, “এক বড় ভাই ফোন দিছে, আমার বাসার সামনে যাওয়া লাগতেছে, তো তুমি আমার বাসায় চইলা আসো, দুই ভাই একসাথে খাবো”। ছেলেটা চাইছিল আমার বাসায় এসে ভাত খাইতে অথচ তাকে রাস্তায় বেধড়কভাবে মাইর খাইতে হইল। মার খাওয়ার পরে ফোনকলে ও আমাকে এটাও বলছিলো যে, “খান! সবাই আমারে একসাথে রোল দিয়ে মারতেছিলো আর একজন বন্দুক তাক করে চিল্লায়ে বলছিলো, চুপচাপ মাইর খা অমুকের পোলা নাইলে গুলি কইরা মাইরা ফালামু, লাশ খুঁজে পাইবো না তোর পরিবার!”

আরও পড়ুনঃ  আ. লীগ-বিএনপি দফায় দফায় সংঘর্ষ, আহত ৫

শান্ত এই কথাটা বলতে বলতে কাঁদতেছিল যে, “আমাকে ছাত্র বইলা বইলা ওরা মারছে আর বারবার বলতেছিল যে এই অমুকের পোলা ছাত্র! ওরে মার!” ওই রাতে আমি বাসা থেকে পালিয়ে যাই।

আমি জানি কয়েকটা পোস্ট, কবিতা লেখা আর ‘রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম’ এর মত কিছু গান করা ছাড়া দেশের জন্য তেমন কিছুই করতে পারি নাই। আমি জানি, আমি আবু সাঈদের মত পথে যেয়ে বুক পেতে দিতে পারি নাই। হয়তোবা এতটুকু সাহস আমার তখন হয় নাই। তবে, আল্লাহ জানেন আর আমি জানি, আমি টাকার কাছে বিক্রি হয় নাই আর দেশের সাথে বেইমানি করি নাই।

এই পোস্ট, পোস্টে শান্তর ছবিগুলা এবং ওদের নির্মমতার কথাগুলা আমি লিখে পোস্ট করছি এই কারণে, যেন ভবিষ্যতে কখনো এই স্বৈরাচারের প্রতি আমার ঘৃণা এতটুকু পরিমাণও কমে না যায়।

উল্লেখ্য, সামাজিক মাধ্যম সূত্রে জানা যায়, যে ইনফ্লুয়েন্সার তাসরিফকে ভিডিও বার্তা দেয়ার কথা বলেন তিনি হলে সোলায়মান সুখন। আর তাকে সহায়তা করেন তৌহিদ আফ্রিদি।

আপনার মতামত লিখুন:
সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ