ওবায়দুল কাদের যখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, তখন এস এম বাহালুল মজনুন চুন্নু ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। পরবর্তী সময়ে কাদের আওয়ামী লীগে নিজের আসন পোক্ত করেন, হন সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু বাহালুল মজনুন চুন্নু বঙ্গবন্ধু সমাজকল্যাণ পরিষদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকলেন।
এ সংগঠনটির তিনি সাধারণ সম্পাদক। রাজধানীর শাহবাগে এই পরিষদের অফিস। আওয়ামী লীগ লম্বা সময় ধরে ক্ষমতায় থাকায় দীর্ঘদিন ধরেই চুন্নু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) সিনেট ও সিন্ডিকেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছিলেন। এর মাধ্যমে ঢাবিতে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলেও চুন্নু এখনো পদে বহাল রয়েছেন। তার সিন্ডিকেটের বেশিরভাগ সদস্য বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জ জেলার।
জানা গেছে, ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন ওবায়দুল কাদের। সেই কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বাহালুল মজনুন চুন্নু। কাদের যেখানে দলের সেকেন্ডম্যান হয়ে গেলেন, সেখানে চুন্নু সমাজকল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হয়েই থাকলেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ২০০৯ সালে তিনি ঢাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য হন। এখন পর্যন্ত তিনি সদস্য হিসেবে আছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র বলছে, ঢাবিতে নিয়োগবাণিজ্যের সিন্ডিকেট তৈরির পাশাপাশি চুন্নু রাজনৈতিক পরিচয়, ঢাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য পরিচয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঢুকেছেন। ঢাবি সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে তিনি একুশে বইমেলা পরিচালনা কমিটিতে থাকেন। এ ছাড়া ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল, ও ইস্ট ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য হয়েছিলেন। হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান তিনি। এ ছাড়া ঢাবি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনেরও সদস্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখে কারচুপির অভিযোগ আছে চুন্নুর বিরুদ্ধে। শিক্ষক থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, টেন্ডারসহ সবকিছু হতো তার ইশারায়। এসব কাজ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অফিসেই তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা আছেন। তারা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগে হস্তক্ষেপ করতেন চুন্নু। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞপ্তি এবং সমন্বয় ও উন্নয়ন (সিঅ্যান্ডডি) কমিটির সভার পর কাজ শুরু হতো তার সিন্ডিকেটের কর্মকর্তাদের। তারা শিক্ষক হতে ইচ্ছুক প্রার্থীর রাজনৈতিক মতাদর্শ খুঁজে বের করতেন। এরপর সেটি চুন্নুকে জানাতেন। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে প্রার্থীর বাড়ি পর্যন্ত চলে যেতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের একজন শিক্ষক প্রার্থী জানান, গত বছর বিভাগে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়। সেখানে আবেদনের পর এক পর্যায়ে আমার বাড়ি থেকে জানানো হয়, পার্শ্ববর্তী জেলার একজন বাবার সঙ্গে দেখা করেছে। সেই ব্যক্তি বলেছে, চুন্নু নামে তার পরিচিত একজন আছেন, যিনি চাইলেই চাকরি হবে।
প্রশাসনিক ভবন সূত্র বলছে, শুধু শিক্ষক নয়, কর্মকর্তা নিয়োগেও হস্তক্ষেপ ছিল এই সিন্ডিকেটের। একইভাবে রাজনৈতিক মতাদর্শ খুঁজে বের করে চুন্নুকে জানানোর কাজ করতেন তারা। এই সিন্ডিকেটের উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হলেন উপাচার্যের অফিসের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মঞ্জুর হোসেন, উপ-উপাচার্যের (শিক্ষা) অফিসের সহকারী রেজিস্ট্রার সুমনা আক্তার, রেজিস্ট্রার অফিসের ডেপুটি রেজিস্ট্রার সালমা বিনতে হক (প্রশাসন-৮), ডেপুটি রেজিস্ট্রার আঞ্জু আরা পারভীন (প্রশাসন-৯), সিনিয়র অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার মাহমুদা সুলতানা হেলেন (প্রশাসন-২), সহকারী রেজিস্ট্রার শেখ মো. গিয়াসউদ্দিন, ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাসুদা আক্তার (প্রশাসন-৩), সহকারী রেজিস্ট্রার মো. আব্দুল হামিদ (প্রশাসন-৪), প্রকৌশল দপ্তরের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মো. মুস্তাফিজুর রহমান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিসের একজন উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের উপ-গ্রন্থগারিক খায়রুল ইসলাম, সহকারী গ্রন্থাগারিক হাফিজুর রহমান ও রুবেল মিয়া, এস্টেট অফিসের সেকশন অফিসার মো. আবদুল কাদের, আইসিটি সেলের সিনিয়র টেকনিক্যাল অফিসার শেখ আনোয়ারুল ইসলাম, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী গ্রন্থাগারিক মো. ইউসুফ আলী এবং হিসাব পরিচালক অফিসের একজন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা।
সূত্র বলছে, সুমনা আক্তার শিক্ষক নিয়োগের সব খুঁটিনাটি জানতেন। কারা প্রার্থী হচ্ছেন, কার বাড়ি কোথায় সবকিছু খোঁজ নিতেন। তার হাত দিয়েই প্রার্থীর ফাইল যেত উপ-উপাচার্যের (শিক্ষা) হাতে। সে সুযোগে প্রার্থী তালিকাসহ শিক্ষক নিয়োগের সব তথ্য চুন্নুর কাছে পাচার করতেন। অনেক ক্ষেত্রে অফিস সহায়ক রেজাউল করিমকে এসব কাজে ব্যবহার করা হতো। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের বোর্ডে থাকতেন সালমা বিনতে হক। চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগ বোর্ডে থাকতেন আঞ্জু আরা পারভীন। চুন্নুর ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করতেন আবদুল হামিদ। টেন্ডার আর কমিশন নিয়ন্ত্রণ করতেন মুস্তাফিজুর রহমান। ক্লায়েন্ট আনার কাজে ছিলেন খায়রুল ইসলাম ও রুবেল মিয়া। বাসা বরাদ্দ বিষয়ক এজেন্ট ছিলেন আবদুল কাদের। চুন্নুর চলার সঙ্গী হিসেবে ছিলেন ইউসুফ আলী। অন্যরা প্রার্থী জোগাড় করা, খবর পাচার করার মতো কাজ করতেন।
চুন্নু সিন্ডিকেটে জড়িত অভিযোগ রয়েছে এমন কর্মকর্তাদের মধ্যে সহকারী রেজিস্ট্রার শেখ মো. গিয়াসউদ্দিন ও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সহকারী গ্রন্থাগারিক রুবেল মিয়ার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। বাকিদের সবাই এই সিন্ডিকেটে যুক্ত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
মঞ্জুর হোসেন বলেন, ‘এ ধরনের সিন্ডিকেট আছে বলে আজ শুনলাম।’ সালমা বিনতে হক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তাদের কোনো সিন্ডিকেট আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। সুমনা আক্তার বলেন, ‘আমার এমন কোনো সিন্ডিকেটের বিষয়ে ধারণা নেই। আমিও কোনোভাবে এর অংশ নই।’ মাহমুদা সুলতানা হেলেন বলেন, ‘আমি কোনো সিন্ডিকেটের অংশ নেই। এগুলো মিথ্যা অভিযোগ।’ মাসুদা আক্তার বলেন, ‘আমি কোনো রাজনীতির মধ্যে নেই। এসব অভিযোগ মিথ্যা।’ আঞ্জু আরা পারভীন বলেন, ‘আমাকে বিএনপি-জামায়াতের লোক বলত বিগত সময়ে। এখনো বলেন। কিন্তু আমি কোনো পক্ষের নই। কোনো সিন্ডিকেটের নই।’ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে যোগাযোগ আছে এটি সত্যি। কিন্তু কোনো সিন্ডিকেটের সদস্য আমি নই।’ শেখ আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘সিন্ডিকেটের লোক হইলেও তাকে দিয়ে আমি কোনোদিন কোনো কাজও করাইনি, কোনো উপকারও পাইনি।’ সহকারী গ্রন্থাগারিক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘চুন্নু ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগের তো কোনো রাস্তা নেই। অত ওপরে যাওয়ার তো সুযোগ নেই আমাদের।’ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বাহালুল হক চৌধুরী বলেন, ‘এগুলো মিথ্যা অভিযোগ। চুন্নুর অনুসারী নই আমি।’
শিক্ষকদের সিন্ডিকেট: শুধু কর্মকর্তা নয়, শিক্ষকদেরও একটি সিন্ডিকেট বানিয়েছেন চুন্নু। এই সিন্ডিকেট নিয়োগ সংক্রান্ত কাজ যেমন করত, তেমনি চুন্নুর সঙ্গে পরিচয় সূত্রে অনেক আত্মীয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ব্যবস্থাও করেছেন। বাহালুল মজনুন চুন্নু যখন ক্যাম্পাসে আসতেন, তখন তাকে ঘিরে হাঁটতেন এসব শিক্ষক। শিক্ষকদের সিন্ডিকেটে রয়েছেন সংস্কৃত বিভাগের একজন অধ্যাপক, একজন সহযোগী অধ্যাপক এবং একজন সহকারী অধ্যাপক; ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের একজন অধ্যাপক এবং সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন প্রভাষক। তবে ওই শিক্ষকরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
এসব বিষয়ে বাহালুল মজনুন চুন্নু কালবেলাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য বাদে আর কোনো সিন্ডিকেট নেই। আমার সঙ্গে অনেকের যোগাযোগ হয় না বা তদবির করি না, এমন নয়। কিন্তু চাকরি দেওয়ার তো কেউ আমি নই। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে সবকিছু স্বচ্ছভাবে হয়, সেটিও আমি বলতে পারব না। কারণ, আমার অগোচরে আমার নাম ভাঙিয়ে কেউ কিছু করলে তা তো আমার জানার কথা নয়।’