27 C
Dhaka
Tuesday, March 25, 2025

মতিউরের ক্যাশিয়ারও শতকোটির মালিক

পেশায় তিনি একজন বীমা কর্মী। পুঁজিবাজারে পরিচিত হয়ে উঠেছেন এনবিআরের আলোচিত কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে। তোফাজ্জল হোসেন ফরহাদ শুধু অন্যের টাকা-পয়সার হিসাব রাখার মধ্যেই সীমিত থাকার লোক নন। তাই তো মতিউরের সঙ্গে সঙ্গে ফুলেফেঁপে উঠেছে তার নিজের অর্থ-সম্পদ।

আলিশান বাড়ি থেকে শুরু করে পুঁজিবাজারে মোটা বিনিয়োগ, তালিকাভুক্ত কোম্পানির লাখ লাখ শেয়ারের মালিকানা আছে তার। দুই ছেলেসহ নিজের নামে গ্লোবাল সু কোম্পানিতে আছে প্রায় ৫০ লাখ শেয়ার। এ ছাড়া গ্লোবাল ম্যাক্স, অর্ণব ট্রেডিং, সিনার্জি ট্রেডিংসহ বেশ কিছু কোম্পানির মালিকানায় রয়েছেন ফরহাদ। নিজ এলাকা নোয়াখালীতেও গড়েছেন অঢেল সম্পদ। শেয়ারবাজার থেকে কারসাজির মাধ্যমে বিপুল মুনাফা করার পর ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চাকরি ছেড়েছেন।

এরপর মতিউরের দাপটে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশনের পরিচালক হয়ে গেছেন এই ফরহাদ। সেখানে নানা অনিয়মের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, তোফাজ্জল হোসেন ফরহাদ কর্মজীবনের বড় সময় পার করেন গ্রিন ডেলটা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। শুল্ক কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সংস্পর্শে এসে বদলে যায় তার জীবন। বাড়তে থাকে সম্পদ ও প্রতিপত্তি। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে ফরহাদ ও তার পরিবার এখন প্রায় শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কর্মী হলেও বড় শিল্পোদ্যোক্তারাও তার প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে ম্লান।

আরও পড়ুনঃ  জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে খালেদা জিয়া: ফখরুল

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তোফাজ্জল হোসেন ফরহাদ বর্তমানে মতিউরের পারিবারিক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এসকে ট্রিমসের চেয়ারম্যান। এই কোম্পানিতে তার শেয়ার সংখ্যা ১৬ লাখ ৯৪ হাজার। আর এসকে ট্রিমসের নামে রয়েছে অন্য সাত কোম্পানির প্রায় ২০ কোটি টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার। সিনার্জি ট্রেডিংয়ে আছে ফরহাদের ৫০ হাজার শেয়ার। এ ছাড়া গ্লোবাল সু কোম্পানিতে ফরহাদ ও তার দুই ছেলের নামে প্রায় ৫০ লাখ শেয়ার রয়েছে। এর মধ্যে তার নিজের নামে আছে ১৬ লাখ ২২ হাজার ৪৫২টি শেয়ার। আর তার ছেলে তাসাদ্দিক হোসেন ফারাবির নামে ২৪ লাখ ৩২ হাজার ৬৬৬ এবং মোসাদ্দেক হোসেন রাইবির নামে ১৬ লাখ ২১ হাজার ৮৮২টি শেয়ার রয়েছে। যদিও দুদকের নোটিশের জবাবে ফরহাদ জানিয়েছিলেন, তার সন্তানদের নামে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে কোনো সম্পদ নেই।

শুধু কোম্পানির মালিকানা নয়, ইন্স্যুরেন্স কর্মী ফরহাদের রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় রয়েছে আলিশান প্রাসাদ। এ ছাড়া নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নিজ গ্রামে একটি আলিশান বাড়ি বানিয়েছেন। ওই এলাকায় নামে-বেনামে বিপুল জমিও কিনেছেন। কৌশলী ফরহাদ তার জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা আয়কর রিটার্নের কোথাও গ্রামের ঠিকানা ব্যবহার করেননি। জাতীয় পরিচয়পত্রে ব্যবহার করেছেন গ্রিন ডেলটা ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয় ও গুলশানের ঠিকানা। আর আয়কর রিটার্নে স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করছেন রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ঠিকানা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তোফাজ্জল হোসেন ফরহাদ কর অঞ্চল-৪-এর আওতায় একজন টিআইএনধারী। কয়েক বছর ধরে তিনি নির্ধারিত সার্কেলে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন না। অন্য কোনো সার্কেলে জমা দেন বলে কর কর্মকর্তাদের ধারণা। যথাযথ প্রক্রিয়ায় স্থানান্তর ছাড়া অন্য কোথাও রিটার্ন দাখিলের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে জানিয়েছেন কর অঞ্চল-৪-এর একাধিক কর্মকর্তা।

আরও পড়ুনঃ  বাংলাদেশ দখল করতে ভারতের ভয়া*বহ পরিকল্পনা!

আইডিআরএ সূত্র জানায়, সাধারণ বীমা করপোরেশনের পরিচালক থাকাকালে তোফাজ্জল হোসেন ফরহাদের বিরুদ্ধে রি-ইন্স্যুরেন্সে ক্লেইম বা দাবি আটকে রেখে অনৈতিকভাবে কমিশন গ্রহণের অভিযোগ ওঠে। আর পরিচালকের ক্ষমতা ব্যবহার করে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলিতেও তিনি প্রভাব বিস্তার করতেন। মতিউরের সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকির ব্যবস্থা করে দেওয়ারও অভিযোগ ওঠে ফরহাদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে সাধারণ বীমার পদ ব্যবহার করে অবৈধ কমিশন বাণিজ্যে জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ফরহাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছিল বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। সেই প্রক্রিয়া বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন এক কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে তদন্ত থেমে যায়। মতিউরের শুভাকাঙ্ক্ষীরাও ওই তদন্ত বন্ধের জন্য তৎপর ছিলেন।

তদন্ত প্রক্রিয়ায় যুক্ত এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘ফরহাদ সাহেব খুবই চালাক প্রকৃতির লোক। উনার তদন্ত শুরু হওয়ার পরই চাপ আসতে থাকে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেও বড় ধরনের চাপ এসেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রভাবশালী এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার জন্য তাকে অব্যাহতি দিতে হয়েছে। আসলে অনেক সময় অনেক কিছু করার থাকে না। ফরহাদের চাকরি ও তার লাইফস্টাইলে বিস্তর ফারাক রয়েছে। আর তার সম্পত্তিতে বড় ধরনের অসামঞ্জস্যতা রয়েছে।’

আরও পড়ুনঃ  শিশুর শরীরের গলা থেকে নিচের অংশ মাটিতে পুঁতে রাখা, ভিডিও নিয়ে তোল*পাড়

জানা গেছে, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) ফরহাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছিল। তদন্তে তার নামে গ্রিন ডেলটা সিকিউরিটিজ, মসিউর সিকিউরিটিজ, আইসল্যান্ড সিকিউরিটিজ এবং লঙ্কাবাংলা সিকিউরিটিজে ছয়টি বিও অ্যাকাউন্টের তথ্য পায় দুদক। এসব বিওএর মাধ্যমে তিনি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। এ ছাড়া বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল সম্পদের তথ্য পাওয়া গেলেও সেই তদন্ত বেশিদূর অগ্রসর হয়নি।

এ বিষয়ে তোফাজ্জল হোসেন ফরহাদ কালবেলাকে বলেন, মতিউর রহমানের সঙ্গে আমার শুধু শেয়ার সংক্রান্ত্র ইস্যুতে লেনদেন হয়েছে। এক টাকার নগদ লেনদেন হয়নি। আইডিআরএর তদন্তে চাপ প্রয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি বীমা কর্মী; দীর্ঘদিন বীমায় চাকরি করেছি। আমি কীভাবে প্রভাব বিস্তার করব? আর অর্থ বিভাগের সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে তিনি চেনেন না বলেও দাবি করেন। এ ছাড়া দুদকের তদন্তের বিপরীতে আপনি বলেছেন, আপনার ছেলেদের নামে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কোনো সম্পদ নেই। আপনার ছেলেদের নামে গ্লোবাল সু কোম্পানিতে প্রায় ৪০ লাখ শেয়ার রয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে ফরহাদ বলেন, এটা দুই বছর আগে নিয়েছি। নির্ধারিত কর সার্কেলে কর দিয়ে আসছি। আর সব সম্পদের কথা কর ফাইলে উল্লেখ রয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

আপনার মতামত লিখুন:
সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ