ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের জন্য দেশি-বিদেশি নানা পক্ষ এখন তৎপর হয়ে উঠেছে। আবারও বিভাজনের রাজনীতি ফিরে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে শেখ হাসিনা যে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিলেন, সেই বয়ান সমাজে হাজির করা হচ্ছে নতুন রূপে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে রাজনৈতিক ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত করার ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে ও নেপথ্যে ভূমিকা পালন করে এসেছে ভারত। কারণ ভারত মনে করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাদের অনুগ্রহে হয়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি যতটা সরব থাকবে, বাংলাদেশের মানুষ ভারতকে ততটা সমীহ করবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে দিল্লি সব সময় ভুল হিসাব করে আসছে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে দলটি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও পলায়নের ঘটনাকেও ভারতের নীতিনির্ধারক এবং গণমাধ্যম একইভাবে মূল্যায়ন করছে। দিল্লি পতিত স্বৈরশাসককে শুধু আশ্রয় দেয়নি, তাকে এখন রাজনীতিতে পুনর্বাসনের কৌশল নিয়েছে।
ভারতের এই কৌশলের ফাঁদে এখন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো পড়েছে বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, গণমাধ্যম, সাংস্কৃতিক মহলসহ সমাজের প্রভাব বিস্তারকারী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ভারতের প্রতি অনুগত ব্যক্তির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এরা পতিত স্বৈরাচারকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের জন্য সফট লাইন বা কোমলনীতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
এই কৌশলের অংশ হিসেবে প্রথমে দাবি আসবে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, সে জন্য রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে কথা বলা শুরু হয়ে গেছে। ক্ষীণ হয়ে আসছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যাসহ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দাবি।
ছাত্র-গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের ঘটনা দিল্লি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। শেখ হাসিনার পলায়নের পর থেকে ভারতের গণমাধ্যমে চলছে বাংলাদেশবিরোধী নানামুখী প্রচারণা। ভারতের নীতিনির্ধারকরা এখনো এই গণআন্দোলনকে স্বীকৃতি দেওয়া তো দূরে থাক, বরং শেখ হাসিনাকে দিল্লি থেকে নানাভাবে রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনার পলায়নের পর গত ১৩ আগস্ট তার পক্ষে এক বিবৃতি প্রকাশ করেন পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। যেখানে তিনি দুই হাজার মানুষকে হত্যায় দুঃখ প্রকাশ তো দূরে থাক, এই আন্দোলনকে সহিংসতা হিসেবে উল্লেখ করে তদন্তের দাবি করেছেন। অথচ সজীব ওয়াজেদ জয় তার মা পালিয়ে যাওয়ার পর প্রথম ভিডিও বার্তায় জানিয়েছিলেন, শেখ হাসিনা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না। এ দেশের মানুষ ও দলের প্রতি তার মা এবং তার পরিবারের আর কোনো দায়দায়িত্ব নেই।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ায় দেশ ও তার দল চরম এক সংকটের মধ্যে পড়ে যায়। প্রায় দুদিন বাংলাদেশ ছিল সরকারহীন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ছাত্র-জনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যান। ফলে পতনের পর দলের নেতাকর্মীরাও হয়ে পড়েন দিশাহীন। অথচ তিনি দাবি করতেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা পালিয়ে যান না। কিন্তু অতীতেও তার পালিয়ে যাওয়ার রেকর্ড ছিল।
২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের পর শেখ হাসিনা এভাবেই দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সেনাসমর্থিত সরকারের চাপের মুখে দেশ ছেড়ে যাননি। তিনি সে সময় বলেছিলেন, বিদেশে তিনি কখনো যাবেন না। এ দেশে তিনি মারা যাবেন।
ভারতের মধ্যস্থতায় সেনা নেতৃত্বের সঙ্গে আপস করে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসেন। এরপর তিনি খালেদা জিয়ার প্রতি প্রতিহিংসামূলক নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এরপর মিথ্যা মামলায় দিনের পর দিন কারাগারে আটকে রাখা হয়। চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, খালেদা জিয়াকে এভাবে আটকে রাখা ঠিক হয়নি। কিন্তু তাদের উপলব্ধি হয়েছে অনেক দেরিতে। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অধিকার যদি হরণ করা না হতো, তাকে যদি নিপীড়নমূলকভাবে কারাবন্দি না করা হতো, তাহলে শেখ হাসিনার পরিণতি এমন নাও হতে পারত।
শেখ হাসিনার পতনের পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর পার্লামেন্টে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তার ভাষার সঙ্গে শেখ হাসিনার বর্তমান বিবৃতির মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। জয়শংকরের বিবৃতিতে পুলিশের গুলিতে নারী, শিশুসহ শত শত মানুষের মৃত্যুর ঘটনা পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়নি।
শেখ হাসিনার প্রথম দেওয়া বিবৃতির পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বিবৃতিতে থেকে স্পষ্ট যে, পতিত স্বৈরাচারকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের জন্য দিল্লি শুরু থেকেই নানামুখী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার প্রচারণার সঙ্গে মিল রেখে ভারত সরকার ও সে দেশের গণমাধ্যম হিন্দু নির্যাতনের নানা কাহিনি প্রচার করতে থাকে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী আছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। তারা আওয়ামী লীগের অন্য নেতাকর্মীদের মতো বিরোধী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার একাধিক আসামি ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে আক্রমণের শিকার হন। একইভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাকর্মীরাও আক্রান্ত হন। এই রাজনৈতিক সহিংসতাকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হিসেবে প্রচারনা শুরু করে ভারতীয় গণমাধ্যম। ভারত সরকার এ নিয়ে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করতে থাকে। বাংলাদেশের ভেতরে হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু নেতাকর্মী বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। এসব বিক্ষোভ সমাবেশে আওয়ামী লীগের মুসলমান নেতাকর্মীদের বিপুল সংখ্যায় দেখা যায়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, হিন্দু সম্প্রদায়কে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ দেশে একটি সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি অংশের মধ্যে উগ্রপন্থা ছড়িয়ে দিতে দীর্ঘদিন থেকে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো কাজ করে আসছে। শেখ হাসিনার পতনের পর ভারত হিন্দু সম্প্রদায়ের এই উগ্রপন্থি অংশটিকে সামনে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে। গণধিকৃত আওয়ামী লীগ এই সাম্প্রদায়িক কার্ডটি খেলা শুরু করে। ইসকনের নামে শুরু হওয়া উগ্র হিন্দুদের বিভিন্ন কর্মসূচির আড়ালে মাঠে নামে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। এরা এতটাই সহিংস হয়ে ওঠে, চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইনজীবীকে হত্যা পর্যন্ত করা হয়।
ভারতের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিবেশ সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের জন্য সরকারকে নমনীয় হতে বাধ্য করা। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের এই ফাঁদে পা দেয়নি। উগ্রপন্থি হিন্দুদের সহিংস আচরণের পরও মানুষ সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখেছে। ফলে প্রাথমিকভাবে ভারত ও আওয়ামী লীগের হিন্দু কার্ড খেলার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
লক্ষ করার বিষয় হলো, ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একজন স্বৈরশাসকের পতনকে বিশ্ব যখন ইতিবাচকভাবে দেখছে, তখন ভারতীয় গণমাধ্যমে একে একটি সহিংস আন্দোলন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ভারতের গণমাধ্যম একই কাজ করে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার পতনের শোক যেন ভারতের গণমাধ্যম ও নীতিনির্ধারকরা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছেন না।
সাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দু নিপীড়নের প্রচারে ব্যর্থ হওয়ার পর ভারতের সরকার ও গণমাধ্যম এই গণঅভ্যুত্থানকে একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখাতে চাইছে। তারা প্রথমে এই আন্দোলনের পেছনে চীন ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা আবিষ্কার করে। অবশ্য সজীব ওয়াজেদ জয় চীনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি নাকচ করে দেন। এরপর এই অভ্যুত্থানের পেছনে সিআইএর সংশ্লিষ্টতার কথা প্রচার করা হতে থাকে। যদিও বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে, ভারতের রাজনীতি ও শেখ হাসিনার সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার নানা ধরনের প্রভাব ছিল। এখনো বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টার সঙ্গে ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা আছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নিরাপত্তাব্যবস্থার সঙ্গে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গভীর সংশ্লিষ্টতা ছিল। অন্তত দুটি গুমের ঘটনার সঙ্গে ভারতের জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আছে। এর মধ্যে একটি মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ড পাওয়া জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার একজন সাক্ষী আদালত প্রাঙ্গণ থেকে গুম হয়ে যান। পরে তাকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জেলখানায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশের আদালতের প্রাঙ্গণ থেকে গুম হওয়া ব্যক্তি কীভাবে ভারতে পাওয়া গেল, তার কোনো ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যায়নি। একইভাবে ২০১৫ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় গুম হন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ। ৬৩ দিন গুম থাকার পর তাকে পাওয়া যায় মেঘালয়ের শিলংয়ে। ঢাকা থেকে গুম হয়ে কীভাবে একজন সুপরিচিত রাজনীতিককে ভারতে পাওয়া গেল, সেই প্রশ্নের কোনো ব্যাখা ভারত সরকার দেয়নি।
এখন জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে গুম হওয়া অনেকে ভারতের কারাগারে আটক আছেন। বাংলাদেশের গুম কমিশনের প্রতিবেদনে ভারতের সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে এসেছে। এরপর ভারতে আটক থাকা গুম হওয়া ব্যক্তিদের পুশব্যাক করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা নিয়ে যখন বাংলাদেশে নানা অভিযোগ, তখন ভারতীয় গণমাধ্যমে একটি সফল গণঅভ্যুত্থানকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাজ বলে প্রচার চালানো হচ্ছে। এসব প্রচারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা মূল্যায়নের ভারতের সেই পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটছে।
ভারতের জন্য শেখ হাসিনা এক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। যার মাধ্যমে দিল্লি বাংলাদেশে এক ধরনের ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করতে পেরেছিল। দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশে ভারতপন্থি রাজনৈতিক দল আছে। কিন্তু শেখ হাসিনা ভারতের স্বার্থে যা করছেন, অন্য দেশের ভারতপন্থি দলগুলো তা করেনি।
শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, তিনি ভারতের জন্য যা করেছেন, ভারত তা চিরদিন মনে রাখবে। ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদকে ভারত শুধু আশ্রয় দিয়ে বসে থাকবে না, তাকে সামনে রেখে বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির নানা চেষ্টা করে যাবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যখন আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের দাবি তোলে, তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা শুধু বাড়ে না, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ