আন্দোলন যখন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে, তখন নাফিসা এবং তার কিছু ফ্রেন্ড মিলে মেসেঞ্জারে গ্রুপ ক্রিয়েট করে নিজেরা ডিসকাশন করে প্রতিদিন রাস্তায় বের হতো। রাজপথে নেতৃত্ব দিতো নাফিসা।
নাফিসার বাবা চা দোকানদার। থাকেন টঙ্গীতে এক রুমের ছোট্ট একটা ভাড়া বাসায়। বাসা থেকে একটু দূরে দোকান। প্রতিদিন সকাল ভোরে ভোরে চলে যান দোকানে, আবার ফিরেন রাত দশটা-এগারোটায়। বাবা বাসায় ফেরার আগেই নাফিসা চলে আসতো বলে আন্দোলনে যাওয়া নিয়ে কিছুই জানতো না ওর বাবা৷ আর্থিক অনটনের কারণে বছর দুয়েক আগে মা কুয়েতে যান কাজ করতে। একমাত্র ছোটবোন থাকে সাভারে নানুর বাসায়। বাবার সাথে থাকতো নাফিসা। মেয়ের পড়ালেখার জন্য রান্না করতে দিত না বাবা, বাসার পাশে এক জায়গায় থেকে খাবারের ব্যবস্থা করতো।
একদিন প্রতিবেশীদের কাছে মেয়ে আন্দোলনে যাওয়ার কথা জানতে পেরে বাসায় ফিরে মেয়েকে বকাঝকা করেন।
এরমধ্যে ২৮জুলাই মেয়ে বলে, সাভারে মামার বাসায় যাব, এখন আর পরীক্ষা হওয়ার সম্ভবনা নাই। (সে এইচএসসি পরিক্ষার্থী ছিল)
তার বাবা ভাবেন, এখানে থাকলে তাকে নিষেধ করে ঘরে আটকিয়ে রাখা যাবে না, আন্দোলনে যাবেই। ঐখানে গেলে হয়ত মামারা বাইরে যেতে দেবে না। দেখেশুনে রাখবে। তাই মামার বাসায় যাইতে দেন৷
বাবার অনুমতি পেয়ে প্রথম ২৮জুলাই ধামরাইয়ে বড় মামার বাসায় যায় নাফিসা। সেখান থেকে ৩০জুলাই সাভারে ছোট মামার বাসায় যায়। ঐখানে গিয়েও ফোনে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করে প্রতিদিন আন্দোলনে চলে যেত। মামারা নিষেধ করলেও শুনতো না কারো কথা। ৩আগষ্ট বিকালে আন্দোলনে থেকে একটা সেলফি তোলে বাবাকে পাঠায়। ঐ ছবি দেখে বাপ রাগে ঘরঘর! কল দিয়ে শুরু করলেন গালমন্দ। তোরে আমি ঐখানে পাঠাইলাম নিরাপদে থাকার জন্য, তুই রাস্তায় গেলি ক্যান।
বাংলাদেশে থাকা ‘২৬ লাখ ভারতীয়র চাকরি বাতিল’ করতে বলল আ.লীগ
বাপের বকাঝকা শুনে ঐদিন সাড়ে ৩টার দিকে ফিরে আসে বাসায়।
৫আগষ্ট সকালে আবারও বের হতে প্রস্তুতি নেয়। এবার ছোট মামা কোনোভাবে বের হতে দেবে না; কিন্তু সে যাবেই যাবে। শেষ পর্যন্ত মামাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নাফিসা বাসা থেকে বের হয়ে সভারে জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটি স্টুডেন্টদের সাথে যোগ দেয় লং-মার্চে।
এরমধ্যে মামা মোবাইলে কথা বলে দ্রুত বাসায় ফিরতে বলে।
দুপুর আনুমানিক আড়াইটার দিকে নাফিসা বাবাকে কল দিয়ে বলে, ‘আব্বু, হাসিনা পলাইছে’।
বাপে রাগত স্বরে বলে ওঠেন, ‘হাসিনা পলাইছে, তোর বাপের কী! তোর বাপ হইল চা দোয়ানদার। তোর কিছু হইলে কে দেখবো!’
নাফিসা বাবাবকে আশ্বস্ত করে, আর কিছু হবে না, আব্বু। হাসিনা পলাই গেছে। ভার্সিটির (জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটি) বড় ভাইয়া-আপুূদের সাথে আছি।
বাপ কড়া নির্দেশ দেন, ‘তাড়াতাড়ি বাসায় যা’।
নাফিসার জবাব আসে, ‘আর পেছনে ফিরে যাওয়ার সময় নাই, আব্বু। আল্লা যা কপালে রাখছে তা হবে।’
বাবার সাথে কথা বলার কয়েক মিনিট পরের ঐদের দলটি যখন সাভার মডেল মসজিদ এলাকা দিয়ে আগাচ্ছিল, শুরু হয় পুলিশ ছাত্রলীগ-যুবলীগের যৌথ হামলা। পুলিশ ছত্রভঙ্গ করতে আন্দোলনকারীদের লক্ষ করে গুলি ছুঁড়ে। মিছিলের সামনে থাকায় গুলিবিদ্ধ হয় নাফিসা। তাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় ল্যাবজোন হাসপাতালে।
এরমধ্যে বাবা একবার কল দেন, বাসায় ফিরছে কিনা তা জানতে, কিন্তু রিসিভ হয় না। কিছুক্ষণ পর আবার বাবার নম্বরে কল আসে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা ছেলের কণ্ঠ শোনা যায়। বলে, আপনি ওর কী হন?
– বাবা।
– তাড়াতাড়ি ল্যাবজোন হাসপাতালে আসেন। ওর গায়ে গুলি লেগেছে।
কনটেন্ট ক্রিয়েটর কাফির ‘নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি’
আচমকা এমন সংবাদ শুনে দিশেহারা বাবা। মাত্র কিছুক্ষণ আগেও মেয়ের সাথে কথা বলেছেন। সে ত বলেছে হাসিনা পলাইছে, এখন কী হলো!
কোনো কিছু বুঝে ওঠতে না পেরে কল দিতে থাকেন নানী, মামাদের। কিন্তু কানেক্ট করতে পারছেন না। দোকান বন্ধ করেই ছুঁটেন সাভারের উদ্দেশ্য। রাস্তায় তেমন গাড়ি নাই। ভেঙে ভেঙে রিক্সা নিয়ে যেতে থাকেন। এদিকে মামাদের কানেক্ট করতে না পেরে কুয়েতে থাকা স্ত্রীকে (নাফিসার মা) কল দিয়ে বলেন, তাদের সবার ফোন কেন বন্ধ। নাফিসার গায়ে গুলি লেগেছে, তাড়াতাড়ি বল ল্যাবজোন হাসপাতালে যাইতে।
(এখানে জানিয়ে রাখি, নাফিসার বাবার সাথে তার মামাদের নানা কারণে সম্পর্ক ভালো ছিল না। তারা কেউ কারো সাথে কথা বলতেন না। মেয়ের এমন দুঃসংবাদ শুনে নাফিসার বাবা রাগ ভেঙে কল দেন নাফিসার মামার নম্বরে। কিন্তু কানেক্ট করতে পারেন নাই। পরে ওর মায়ের মাধ্যমে কথা বলে, তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে।)
এরমধ্যে আবার মামারাও খবর পেয়ে ছুটে যান ল্যাবজোন হাসপাতালে। ততক্ষণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে নাফিসা। নিয়ে যাওয়া হয় এনাম মেডিকেলের দিকে। পথে মারা যান নাফিসা। (মামার ভাষ্য অনুযায়ী, ল্যাবজোন হাসপাতালে থাকা অবস্থায়ই মারা যায়।)
এনাম মেডিকেলে আনার পরও তার ব্লিডিং বন্ধ করা যাচ্ছে না। মেডিকেল থেকে লাশ নিয়ে ফেরার পথে মুক্তির মোড়ে আরেক দফায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলার শিকার হয় মামারা। পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হন মামা। পরে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে বিকাল সাড়ে চারটার পর নাফিসাকে নিয়ে আসা হয় মামার বাসায়। ততক্ষণেও তার বাবা এসে পৌঁছাইতে পারেন নাই।
সাভারে রাত ৯টায় প্রথম জানাযা শেষে নিয়ে যাওয়া হয় টঙ্গীতে বাবার এলাকায়। ঐখানে যাওয়ার জন্য কোনো অ্যাম্বুলেন্স খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ৪গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে পিক-আপ করে মেয়ের লাশ নিয়ে ফেরেন এরশাদনগরে পৈতৃক ভিটামাটিতে। দ্বিতীয় জানাযা শেষে এলাকার কবরস্থানে দাফন করা হয় নাফিসাকে।
বাংলাদেশের রাস্তায় বৃদ্ধার উচ্ছিষ্ট খাওয়ার ছবিটি আ.লীগের সময়কার
ওর পুরো নাম নাফিসা হোসেন মারওয়া৷ ইন্টার প্রথম বর্ষ সাভার ল্যাবরেটরি কলেজে পড়ে মাইগ্রেশান করে চলে যায় টঙ্গি সাহাজউদ্দিন সরকার আদর্শ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ঐখানে বাবার সাথে থাকতো। মা চলে যায় কুয়েতে। ছোট বোনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নানুর কাছে। বাবার চা দোকান থেকে যা আয় হতো তা দিয়ে প্লাস মায়ের পাঠানো টাকায় চলতো নাফিসার পড়ালেখার খরচ ও ঐ বাসাটার ভাড়া। গত সপ্তাহে এইচএসসির রেজাল্ট বেড়িয়েছে, নাফিসা পেয়েছে জিপিএ ৪.২৫। এসএসসির রেজাল্ট মার্জিন করা না হলে জিপিএ পয়েন্ট আরও বাড়তো।
যখন কথা বলছিলাম নাফিসার বাবার সাথে, কান্নাভেজা কণ্ঠে মোবাইলে ওপাশ থেকে বলেন, আমি দোকানে বসি, কিন্তু আমার মন পড়ে থাকে মেয়ের কথায়। মেয়ে পাশ করে আমার কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, আমার মেয়েটা পাশের রেজাল্টটা জানতে পারলো না। মেয়ের সাথে আমার শেষ কথা হয়েছে:
‘আব্বু, আমি ত বাঁচব না, লাশটা নিয়ে যাইয়ো’।
পরিবারের শত বাঁধা উপেক্ষা করেও প্রয়োজনের তাগিদে নাফিসারা বীরের বেশে রাস্তায় আসেন, লাশ হয়ে ফেরেন ঘরে। সফলতার আড়ালে থেকে যায় তাদের সাহসীকতার গল্প। জুলাই গণআন্দোলনে এমন হাজারও নাফিসা ছিল, যারা রাস্তায় আসতে হয়েছিল ঘরে বাবা-মায়ের সাথে যুদ্ধ করে। আবার রাস্তায় এসেও করেছেন আওয়ামী হায়েনা ও পুলিশলীগের সাথে যুদ্ধ।
এই সাহসী যোদ্ধা শহীদ নাফিসাকে আমরা আজীবন স্মরণে রাখতে পারব, তো?