অভাব-অনটনের সংসারে বড় হয়েছেন মো. আল আমিন হাওলাদার। তার বাবার সামান্য ভাতের হোটেল ছাড়া আর তেমন কিছু নেই। তিনি প্রতিদিন নিয়ম করে ওই হোটেলে কাজ করেন, বাবাকে সহযোগিতা করেন। কাজের ফাঁকে পড়াশোনাও করেন ঠিকঠাক মতো। আদম্য মেধাবী আল আমিন এবার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন।
২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় ২০০ নম্বরের মধ্যে আল আমিনের স্কোর ১৮৬ দশমিক ২৫। মেধাতালিকায় ১১৭তম হয়েছেন। তিনি ঢাকা মেডিকেলে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছেন।
মো. আল আমিন হাওলাদারের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামে। তার বাবার নাম মো. নিজাম উদ্দিন হাওলাদার, মায়ের নাম নাজমা বেগম। চার ভাই-বোনের মধ্যে আল আমিন দ্বিতীয়।
ছেলের সাফল্যে যারপরনাই আনন্দিত নিজাম উদ্দিন হাওলাদার বলেন, ‘ছেলেকে মানুষ করার জন্য খাবার হোটেলের ব্যবসা করেছি। রিকশা চালিয়েছি। রাতের বেলাও শ্রমিকের কাজও করেছি। আজ আর সেসব মনে নাই। কারণ, আমার ছেলে ডাক্তার হবে।’
নিজাম উদ্দিন জানান, তার বসতভিটা ছাড়া কিছুই নেই। বাড়ির কাছে ছোট এক কক্ষের একটি ভাড়া ঘরে খাবার হোটেলের ব্যবসা করেন। পাশাপাশি অন্যের জমিতে কৃষিকাজও করেন। তার স্ত্রী একজন গৃহিণী। নিত্য অভাবের সংসারেই কষ্ট করে বড় করছেন সন্তানদের।
মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় সাফল্যের পেছনের কথা জানিয়ে আল আমিন বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণিতে আমার রোল নম্বর ছিল ১৮। এরপরও বৃত্তি দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সিদ্ধান্ত ১৫ জনের বেশি ছাত্রের বৃত্তির জন্য আলাদা পাঠদান করাবেন না এবং বৃত্তির জন্য ফরম পূরণ করাবেন না। এ কারণে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারিনি। বিষয়টি আমাকে নাড়া দিয়েছিল। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে পড়াশোনা করে বড় হতে হবে। সেই স্বপ্ন পূরণে আজ এক ধাপ এগোলাম। আমার বিশ্বাস, সবার দোয়ায় ভালো কিছু করতে পারব ইনশা আল্লাহ।’
ভবিষ্যতে আল আমিন পড়তে চান মেডিসিন নিয়ে। অসহায় ও দুস্থ মানুষের জন্য কিছু করতে চান। তিনি বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় সহপাঠীদের সঙ্গে খেলাধুলা না করে পড়াশোনায় মনোযোগ ছিল আমার। পড়াশোনার পাশাপাশি তখন থেকেই বাবাকে সহযোগিতা করতাম, হোটেলে বাবার সঙ্গে কাজ করতাম।’ এতে তার খারাপ লাগত না, ভালো লাগত।
পরিবারের সদস্যরা জানান, অভাবের কারণে নিজ গ্রামের মাধবপুর নিশিকান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন আল আমিন। ২০২২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করেন। এরপর বরিশাল সরকারি কলেজে ভর্তি হন। অর্থের অভাবে অন্য সহপাঠীদের মতো মেসে উঠতে পারেননি। বরিশালে থাকার ব্যবস্থা করতে না পারায় কলেজে ক্লাস করতে পারেননি। কিন্তু পড়াশোনা থেকে সরে যাননি। সব সময় চিন্তা ছিল তাকে বড় হতে হবে। বাবা ও মায়ের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে। এ কারণে বাড়িতে বসে প্রায় এক বছর বাবার সঙ্গে নিয়মিত হোটেলে কাজ করেছেন এবং মুঠোফোনের মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাস করেছেন।
আল আমিনের বাবা নিজাম উদ্দিন হাওলাদার জানান, ছোট টিনের ঘর ও ভিটা ছাড়া কিছুই নেই তার। জীবনে কোনো দিন কোনো কিছুর জন্য বায়না করেনি আল আমিন। ছোটবেলা থেকেই ছেলেটা খুবই ভালো, পড়তে বলা লাগেনি। হোটেলে কাজ করেছে, আবার পড়াশোনাও করেছে। যেদিন ফলাফল প্রকাশিত হয়, সেদিনও দোকানে বসে পুরি ও সমুচা বানিয়েছে, ভাত বিক্রি করেছে। আল আমিন ডাক্তারিতে চান্স পাওয়ায় তিনি ও তার পরিবারের সবাই গর্বিত। তিনি ছেলের জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন।