বঙ্গবন্ধু’ বললেই দেশের মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানকে বোঝেন। শেখ মুজিবের এই উপাধি বা খেতাব রাষ্ট্রীয় নয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় (২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯) ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি জনসভায় ছাত্রলীগের তখনকার নেতা তোফায়েল আহমেদ এই খেতাব দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবকে।
তবে এরও প্রায় ৭৮ বছর আগে এই বাংলারই একজন সমাজ সংস্কারক ও ধর্ম প্রচারক মুন্সী মেহেরুল্লাহকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি বা খেতাব দেওয়া হয়েছিল। তাকে এই উপাধি দিয়েছিলেন লেখক ও সংগঠক মির্জা ইউসুফ আলী।
মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহই যে প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিপ্রাপ্ত, এ ব্যাপারে নিশ্চিত ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষক ড. মো. জহুরুল ইসলাম। সাতক্ষীরার শ্যামনগর সরকারি মহসীন কলেজের এই শিক্ষক ‘মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ : হিজ লাইফ অ্যান্ড কন্ট্রিবিউশন’ শীর্ষক পিএইচডি অভিসন্দর্ভে এই তথ্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি ২০০১ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া থেকে ড. মুহাম্মদ ইয়াহিয়া রহমানের তত্ত্বাবধানে এই অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
মেহেরুল্লাহর কর্মজীবনের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে ড. জহুরুল লেখেন, “…মুন্সী সাহেবের এরূপ জনপ্রিয়তা ও বাংলার অধিবাসীদের প্রতি সমান মমত্ববোধ ও দয়া থাকার কারণে তৎকালীন সভ্যসমাজ কর্তৃক প্রদেয় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি যথার্থই হয়েছে। প্রখ্যাত লেখক ও সমাজ সংস্কারক রাজশাহীর অধিবাসী মির্জা ইউসুফ আলী মুন্সী সাহেবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মির্জা ইউসুফ ১৮৯১ সালে রচিত তার প্রসিদ্ধ ও প্রথম মৌলিক গ্রন্থ ‘দুগ্ধ-সরোবর’- এর ভূমিকাতেই মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ সাহেবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে আখ্যায়িত করেন।”
ড. জহুরুল বলছেন, “মির্জা ইউসুফের উক্ত গ্রন্থে সমকালীন মুসলিম বাংলার উন্নয়নমূলক যে মহাপরিকল্পনা উত্থাপিত হয়, তার পুরোগামী হিসেবে সমকালীন ‘বঙ্গবন্ধু’ মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।”
এক প্রশ্নে ড. জহুরুল বলেন, “থিসিস পেপারের ওপর আয়োজিত সেমিনারে পিএইচডি কমিটির সভাপতি তখনকার উপাচার্য ড. মোস্তাফিজুর রহমান আমাকে প্রশ্ন করেন, মুন্সী মেহেরুল্লাহ ‘বঙ্গবন্ধু’ হলেন কীভাবে? আমি রেফারেন্সসহ উত্তর দিয়ে ড. মোস্তাফিজুরসহ সেখানে উপস্থিত শতাধিক স্কলার ও মাস্টার্স লেভেলের শ’তিনেক শিক্ষার্থীকে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হই। যথাযথ উত্তর না দিতে পারলে আমাকে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হতো না।”
মুন্সী মেহেরুল্লাহই যে বাংলার প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’, এ কথা লিখেছেন মতিউর রহমান মল্লিকও। ঢাকাভিত্তিক ‘প্রেক্ষণ সাহিত্য সংগঠন’ ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে ‘মুন্সী মেহেরুল্লাহ স্মরণ সংখ্যা’ প্রকাশ করে। সেখানে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি মির্জা ইউসুফ আলী যে মুন্সী মেহেরুল্লাহকে প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেন, এ কথা জানিয়েছেন।
অধ্যাপক মুহম্মদ আবু তালিবের লেখা ‘মুন্সী মেহেরুল্লাহ : দেশ কাল সমাজ’ গ্রন্থ উদ্ধৃত করে একই নিবন্ধে বলা হয়, “সমকালীন মুসলিম মনীষীরা মুন্সী সাহেবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে সম্বোধন করেছেন।” নিবন্ধে তিনি মুন্সী মেহেরুল্লাহর কর্মজীবনের ওপর আলোকপাত করে তার অর্জিত অন্য সব খেতাবের কথাও উল্লেখ করেন। তার মধ্যে রয়েছেÑ ‘কর্মবীর’, ‘মোসলেমহিতৈষী’, ‘দীনের মশাল’ প্রভৃতি।
দৈনিক নয়াদিগন্তের সাহিত্য বিভাগে দীর্ঘদিন কাজ করা লেখক, গবেষক নাসির হেলাল; মুন্সী মেহেরুল্লাহকে নিয়ে যার নিজেরও অনেক কাজ আছে। তিনি বলেন, মুন্সী মেহেরুল্লাহকেই যে এই জনপদে প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করা হয়, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য।
ঊনবিংশ শতাব্দীর লেখক, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ, ধর্ম প্রচারক মির্জা মোহাম্মদ ইউসুফ আলী তাকে ‘দুগ্ধ-সরোবর’ বইয়ে এই খেতাব দেন। ১৮৫৮ সালে জন্ম নেওয়া মির্জা ইউসুফ ১৮৯১ সালে ‘দুগ্ধ-সরোবর’ গ্রন্থটি লিখেছিলেন, যার কপি এখন দুষ্প্রাপ্য।